দেশে দেশে বইমেলা ও অমর একুশে বইমেলার ইতিহাস:

 


আধুনিক বিশ্বে যতরকম মেলা হয়ে থাকে এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো বইমেলা। পৃথিবীর অনেক দেশেই এ মেলার আয়োজন করা হয়। এসব মেলায় ভিড় করে লাখ লাখ মানুষ। ভারতীয় উপমহাদেশেও প্রচুর মেলা বসে।

এশিয়ার বাইরে কায়রো আন্তর্জাতিক বইমেলা এর মধ্যে অন্যতম। বলা হয়ে থাকে সর্ব সাধারণের জন্য উন্মুক্ত এটিই পৃথিবীর প্রথম বইমেলা। প্রতিবছর জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারীতে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।  ২০১৯ সালে এর সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠিত হয় এবং একই বছর পুরোনো আয়োজনস্থল নাসর সিটি থেকে সরিয়ে নতুন কায়রোর প্রান্তে তাগামোয়া এল খামিসে নিয়ে আসা হয় ।

এশিয়া, আফ্রিকা মহাদেশ, ইউরোপ  ও আমেরিকা মহাদেশ থেকে বহু প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করে থাকে এই ঐতিহ্যবাহী  আয়োজনে। লাখো মানুষের পদচারণায় প্রতিবছর মুখরিত হয়ে উঠে এই বইমেলা ।

 

কায়রোর চেয়েও অনেক পুরোনো ফ্রাঙ্কফুর্টার বুকামেসা বা জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা। সাধারণ পাঠকের উন্মুক্ত বইমেলার চেয়েও এই মেলা অনেক বেশি প্রকাশক আর ব্যবসায়ীদের কেন্দ্রস্থল । অক্টোবরের মাঝামাঝি অনুষ্ঠিত হওয়া পাঁচ দিনব্যাপী এ মেলার শেষ দুই দিন সর্বসাধারণের প্রবেশের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় । প্রায় চার মিলিয়ন বর্গফুট আয়তনের জায়গায় করা হয়ে থাকে এর আয়োজন। প্রথম তিন দিন প্রকাশক, সম্পাদক, প্রকাশনা সংস্থা, লাইব্রেরিয়ান, লেখক, লাইসেন্সবিষয়ক লোকেদের জন্য সংরক্ষিত থাকে।

ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, খ্রিষ্টীয় পনেরো শতকে জোহানস গুটেনবার্গ মুদ্রণযন্ত্র বা ছাপাখানা আবিষ্কার করেন এবং সেই সময় থেকেই বইমেলার সূচনা হয় জার্মানিতে।

 

প্রাচীন চীনারা বই সংগ্রহ শুরু করে ৯৬০ সালের পরে। তারা এর নাম দেয় শানবিন। বইকে তারা খুবই গুরুত্ব দিতো। তাদের সংস্কৃতি  ইতিহাসকে ধরে রাখার জন্যই বই সংগ্রহ শুরু করে চীনারা। পৃথিবীতে এই বই সংগ্রহের রীতিটি বেশ পুরনো। সক্রেটিস আমলেও ছিল বলেও জানা যায়।

অনেকের মতে জার্মানির লিপজিগ শহরে প্রথম বইমেলা হয়েছিল। কিন্তু কারও কারও ধারণা এর বিপরীত। তারা মনে করেন, প্রথমে বইমেলা শুরু হয় ফ্রাঙ্কফুর্টে, লিপজিগ খুব বড় করে মেলার আয়োজন করায় ওটার নামই লোকজন জানতো বেশি।

সে সময় বইমেলাগুলো তেমন জনপ্রিয়তা না পেলেও সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১৭ শতকের পর ইউরোপসহ বিশ্বের আরও কিছু দেশে বইমেলা শুরু হয়।

 

সারাবিশ্বে এখন অনেকগুলো আন্তর্জাতিক বইমেলা হয়ে থাকে। সেখানে লোকজনের ভিড়ও জমে দেখার মত। এর মধ্যে অন্যতম বইমেলাগুলো হলো- লন্ডন বইমেলা, আন্তার্জাতিক কলকাতা বইমেলা, নয়াদিল্লি বইমেলা, কায়রো বইমেলা, হংকং বইমেলা, বুক এক্সপো আমেরিকা (বিইএ), আবুধাবি বইমেলা ইত্যাদি।

 

আর আমাদের বাংলাদেশে অমর একুশে গ্রন্থমেলা নামে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে চলে বইমেলা। বাংলাদেশে বইমেলার উদ্ভবের ইতিহাস খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। বইমেলার চিন্তাটি এ দেশে প্রথমে মাথায় আসে প্রয়াত কথাসাহিত্যিক জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক সরদার জয়েনউদদীনের। তিনি বাংলা একাডেমিতেও একসময় চাকরি করেছেন। বাংলা একাডেমি থেকে ষাটের দশকের প্রথম দিকে তিনি গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক পদে নিয়োগ পান।

তিনি যখন বাংলা একাডেমিতে ছিলেন, তখন বাংলা একাডেমি প্রচুর বিদেশি বই সংগ্রহ করত। এর মধ্যে একটি বই ছিল Wonderful World of Books. এই বইটি পড়তে গিয়ে তিনি হঠাৎ দুটি শব্দ দেখে পুলকিত বোধ করেন। শব্দ দুটি হলো: Book এবং Fair । বইয়েরও যে মেলা হতে পারে এবং বইয়ের প্রচার-প্রসারের কাজে এই বইমেলা কতটা প্রয়োজনীয়, সেটি তিনি এই বই পড়েই বুঝতে পারেন।

ওই বইটি পড়ার কিছু পরেই তিনি ইউনেস্কোর শিশু-কিশোর গ্রন্থমালা উন্নয়নের একটি প্রকল্পে কাজ করছিলেন। কাজটি শেষ হওয়ার পর তিনি ভাবছিলেন বিষয়গুলো নিয়ে একটি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করবেন। তখন তাঁর মাথায় আসে, আরে প্রদর্শনী কেন? এগুলো নিয়ে তো একটি শিশু গ্রন্থমেলাই করা যায়। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। তিনি একটি শিশু গ্রন্থমেলার ব্যবস্থাই করে ফেললেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরির (বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি) নিচতলায়। যত দূর জানা যায়, এটাই ছিল বাংলাদেশের প্রথম বইমেলা। এটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৬৫ সালে।

 

১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সহযোগিতায় নারায়ণগঞ্জে একটি গ্রন্থমেলার আয়োজন করা হয়। এই মেলায় আলোচনা সভারও ব্যবস্থা ছিল। সে সব আলোচনায় অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তৎকালীন প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ আব্দুল হাই, শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ও সরদার ফজলুল করিম।

এই মেলায় সরদার জয়েনউদদীন একটি মজার কাণ্ড করেছিলেন। মেলায় যে রকম বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন, উৎসুক দর্শকেরাও এসেছিলেন প্রচুর, বইয়ের বেচাকেনাও মন্দ ছিল না কিন্তু তাদের জন্য ছিল একটি রঙ্গ-তামাশাময় ইঙ্গিতধর্মী বিষয়ও। মেলার ভেতরে একটি গরু বেঁধে রেখে তার গায়ে লিখে রাখা হয়েছিল আমি বই পড়ি না। সরদার জয়েনউদদীন সাহেবের এই উদ্ভাবনা দর্শকদের ভালোভাবেই গ্রন্থমনস্ক করে তুলেছিল বলে অনুমান করা হয়।

 

১৯৭২ সালে তিনি যখন গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক, তখন ইউনেস্কো ওই বছরকে আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ হিসেবে ঘোষণা করে। গ্রন্থমেলায় আগ্রহী সরদার সাহেব এই আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ উপলক্ষে ১৯৭২ সালে ডিসেম্বর মাসে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একটি আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন। সেই থেকেই বাংলা একাডেমিতে বইমেলার সূচনা।

উপরোক্ত তথ্যের বাহিরেও যতদূর জানা যায়, ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে চিত্তরঞ্জন সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গণে বটতলায় এক টুকরো চটের ওপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলার গোড়াপত্তন করেন।

তবে আরেকটি তথ্যমতে ১৯৭২ সালে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলা একাডেমির একুশের অনুষ্ঠানে কোনো বইমেলা হয়নি। তবে বাংলা একাডেমির দেয়ালের বাইরে স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্সের রুহুল আমিন নিজামী তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রগতি প্রকাশনীর কিছু বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসেন। তার দেখাদেখি মুক্তধারা প্রকাশনীর চিত্তরঞ্জন সাহা এবং বর্ণমিছিলের তাজুল ইসলামও ওভাবেই তাদের বই নিয়ে বসে যান।

 

১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে একটি বিশাল জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই মেলার উদ্বোধন করেন। সে উপলক্ষে নিজামী, চিত্তবাবু এবং বর্ণমিছিলসহ সাত-আটজন প্রকাশক একাডেমির ভেতরে পূর্ব দিকের দেয়ালঘেঁষে বই সাজিয়ে বসে যান। সে বছরই প্রথম বাংলা একাডেমির বইয়েরও বিক্রয়কেন্দ্রের বাইরে একটি স্টলে বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়। এভাবেই বিচ্ছিন্ন বই বিক্রির উদ্যোগের ফলে ধীরে ধীরে বাংলা একাডেমিতে একটি বইমেলা আয়োজনের জন্য গ্রন্থমনস্ক মানুষের চাপ বাড়তে থাকে।

 

১৯৮৩ সালে কাজী মনজুরে মওলা সাহেব যখন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক, তখন তিনি বাংলা একাডেমিতে প্রথম অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজন সম্পন্ন করেন। কিন্তু স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষা ভবনের সামনে ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে ট্রাক তুলে দিলে দুজন ছাত্র নিহত হয়। ওই মর্মান্তিক ঘটনার পর সেই বছর আর বইমেলা করা সম্ভব হয়নি।

 

১৯৮৪ সালে সাড়ম্বরে বর্তমানের অমর একুশে গ্রন্থমেলার সূচনা হয়। এরপর প্রতিবছর বইমেলা বিশাল থেকে বিশালতর আকার ধারণ করে। মেলা উপলক্ষে বিপুল বই প্রকাশিত হয়। বলা চলে এই মেলা উপলক্ষ করেই বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প একটি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গেছে।

এখন অনেক নতুন প্রকাশক এই শিল্পে এসেছেন। পাঠকেরা সংখ্যাও প্রতিবছর বাড়ছে। এই মেলা এক মাস ধরে চলে। পৃথিবীতে আর কোনো বইমেলাই এত দিন ধরে চলে না। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে এটি পৃথিবীর দীর্ঘদিনব্যাপী আয়োজিত একটি বইমেলা।

অমর একুশে গ্রন্থমেলা, ব্যাপকভাবে পরিচিত একুশে বইমেলা, স্বাধীন বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মেলাগুলোর অন্যতম। প্রতি বছর পুরো ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে এই মেলা বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গণে ও বর্ধমান হাউজ ঘিরে অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে অমর একুশে গ্রন্থমেলা বাংলা একাডেমির মুখোমুখি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। তবে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনেও মেলার একটি অংশ আয়োজন করা হয়।

 

২০২৩ সালে অমর একুশে বইমেলায় মোট ৪৭০ টি বইয়ের  স্টল  বসেছিলো আর নতুন বই প্রকাশিত হয়েছিলো প্রায় ৪ হাজার। মোট বই বিক্রি হয়েছিলো প্রায় ৫০ কোটি টাকার উপরে ।

 

বরাবরের মতো এবারও বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রায় সাড়ে ১১ লাখ বর্গফুট জায়গায় বসেছে এবারের বইমেলা। ৬৩৫টি প্রতিষ্ঠানকে মোট ৯৩৭টি স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

 

লেখক : জাহিদুর রহমান

৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

 

 

তথ্যসূত্র :

১. bn.wikipedia.org/wiki/অমর_একুশে_গ্রন্থমেলা

২. prothomalo.com/onnoalo/books/বইমেলা-দেশে-দেশে

৩. ekushey-tv.com/literature/news

৪. বশীর আলহেলাল, বাংলা একাডেমির ইতিহাস

Comments

Popular posts from this blog

করোনা মহামারী ও সাম্প্রতিক পৃথিবী

করোনা প্রতিষেধক আবিষ্কার